টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা ব্রোকলি ও বাঁধাকপি চাষ
মো: হুসাইন আহমেদ
এপেক্স বায়োটেক পরীক্ষামূলকভাবে টিস্যু কালচারের মাধ্যমে ব্রোকলি ও বাঁধাকপির ৫০০টি চারা উৎপাদন করেছে এবং মাঠে চারা রোপণ করা হয়েছে।
টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত চারা বালাইনাশক/ কীটনাশক ব্যবহার করা লাগে না। দ্রুত বর্ধনশীল হয়। ওজন বেশি হয়। অধিক সংখ্যক চারা উৎপাদন করা সম্ভব। মোজাইক ভাইরাস আক্রমণ প্রতিরোধী হয়।
ব্রোকলির জাত পরিচিতি
ব্রোকলি আমাদের দেশে নতুন সবজি। কাজেই এখন পর্যন্ত তেমন কোন ভালো জাত আমাদের দেশে নেই। উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি জাত যেমন- প্রিমিয়াম ক্রস, গ্রিন কমেট, জুপিটার প্রভৃতি জাতের ব্রোকলি চাষ করা যায়। লালতীর সিডস লিমিটেড ‘লিডিয়া’ নামে ব্রোকলির একটি জাত বাজারজাত করছে, যা আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী। জাতটি দ্রুত বর্ধনশীল, মাঝারি আকৃতির, তাপসহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী, দেখতে আকর্ষণীয় ও খেতে সুস্বাদু।
ব্রোকলির বপন/রোপণ প্রযুক্তি
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ব্রোকলি চাষের উত্তম সময় হলো আশ্বিন থেকে পৌষ মাস। চারা রোপণের আগে বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) প্রায় ৫০ গ্রাম বীজ বপন করে বীজতলায় চারা তৈরি করতে হবে। এরপর মূল জমিতে চাষের জন্য বিঘা প্রতি ৬ হাজার চারা রোপণ করতে হবে। প্রায় ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ বয়সের চারা সারি থেকে সারি ২২ ইঞ্চি ও চারা থেকে চারা ১.৫ ফুট দূরত্বে রোপণ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ১ ফুট চওড়া এবং ৬ ইঞ্চি গভীর নালা রাখতে হবে।
ব্রোকলি চাষে সার ব্যবস্থাপনা
ব্রোকলির ভালো ফলন পাওয়ার জন্য প্রতি শতাংশ (ডেসিমাল) জমির জন্য সার প্রয়োগ করতে হবে।
পচা গোবর/কম্পোস্ট ৬০ কেজি, এ ছাড়াও ৭৬০ গ্রাম খৈল প্রয়োগ করা যেতে পারে। টিএসপি ০.৭৬ কেজি, ইউরিয়া ০.৪৫, এমওপি/পটাশ ০.৬১ কেজি, জিপসাম ০.৩২-০.৪ কেজি, দস্তা সার ০.০৫ কেজি, বোরন ০.০৪ কেজি প্রয়োগ করা যেতে পারে যা এলাকা বা মৃত্তিকাভেদে কমবেশি হতে পারে।
উপরোক্ত সার মূল জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। বিঘাপ্রতি ২ কেজি হারে রুটোন বা অন্য কোন শিকড় বর্ধনকারী হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় জিংক ও বোরন না প্রয়োগ করে চারা লাগানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম লিবরেল জিংক ও ২০ গ্রাম লিবরেল বোরন একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করা যায়। তবে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করা উত্তম।
ব্রোকলি সংগ্রহ ও পরবর্তী করণীয়
চারা রোপণের দুই মাসের মধ্যে ব্রোকলির অগ্রীয় প্রোপুষ্পমঞ্জরি খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায়। তবে সঠিক মানের জৈব হরমোন ব্যবহার করলে প্রায় ১০ দিন আগে ফসল সংগ্রহ করা যায়। প্রায় তিন ইঞ্চি কা-সহ ধারালো ছুরি দিয়ে ফুল কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এর ১০ থেকে ১২ দিন পর পর্যায়ক্রমে বোঁটাসহ কক্ষীয় প্রোপুষ্পমঞ্জরি সংগ্রহ করতে হয়। সঠিক পরিচর্যা করলে বিঘাপ্রতি ৫০-৬৫ মণ ফলন পাওয়া যায়।
বাঁধাকপি
বাঁধাকপি (ঈধননধমব) রবি মৌসুমের একটি প্রধান সবজি ফসল, বৈজ্ঞানিক নাম (ইৎধংংরপধ ড়ষবৎধবধ াধৎ পধঢ়রঃধঃধ)। বাংলাদেশের প্রায় সব অঞ্চলেই বাঁধাকপি চাষ হয়ে থাকে। এদেশে বাঁধাকপির যে সকল জাতগুলো রয়েছে প্রায় সব হাইব্রিড ও বিদেশি জাত। যে সকল জাতের বাঁধাকপি চাষ করা হয়ে থাকে তার সব জাতের বীজ এদেশে উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। যে সব জাতের বীজ উৎপাদন করা যায় সে জাতগুলো হলো বারি উদ্ভাবিত জাত। বারি বাঁধাকপি-১ (প্রভাতী), বারি বাঁধাকপি-২ (অগ্রদূত), বারি চীনাকপি, ইপসা বাঁধাকপি-১ এসব উন্নত জাত।
প্রতি ১০০ গ্রাম বাঁধাকপিতে ৯১.৯ গ্রাম পানি, ১.৮ গ্রাম আমিষ,০.১ গ্রাম চর্বি, ০.৬ গ্রাম খনিজ, ১.০ গ্রাম আঁশ, ৪.৬ গ্রাম শ্বেতসার রয়েছে। খনিজ লবণের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম ৩৯ মিগ্রা, ম্যাগনেসিয়াম ১০ মিগ্রা, ফসফরাস ৪৪ মিগ্রা, লৌহ ০.৮ মিগ্রা, সোডিয়াম ১৪.১ মিগ্রা, কপার ০.০৮ মিগ্রা ও সালফার ৬৭ মিগ্রা।
বাঁধাকপি উৎপাদন প্রযুক্তি : আগাম জাতের জন্য শ্রাবণ-ভাদ্র থেকে ভাদ্র-আশ্বিন, মধ্যম আশ্বিন-কার্তিক, কার্তিক-অগ্রহায়ণ এবং নাবি জাতের জন্য অগ্রহায়ণ-মধ্য পৌষ থেকে পৌষ-মধ্য মাঘ। গভীরভাবে ৪-৫টি চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে তৈরি করতে হবে। বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর বা ৫/৬টি পাতা বিশিষ্ট ১০-১৫ সেন্টিমিটার লম্বা চারা সাধারণত বিকেল বেলা জমিতে রোপণ করতে হয়। তবে সুস্থ ও সবল হলে চারা এক-দেড় মাস বয়সের চারা রোপণ করা যায়। রোপণের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৪ ইঞ্চি এবং প্রতি সারিতে চারা থেকে চারার দূরত্ব ১৮ ইঞ্চি দিলে ভালো হয়। এ হিসেবে প্রতি শতকে ১৫০টির মতো চারার প্রয়োজন হয়। আঙ্গিনায় ৫ মিটার লম্বা একটা বেডের জন্য ২০-২২টি চারার প্রয়োজন হয়। বেডে দুই সারিতে চারাগুলো লাগাতে হবে। আঙ্গিনায় লাগানোর জন্য যেহেতু কম চারার দরকার হয় সেজন্য কোন বিশ্বস্ত-নার্সারি থেকে চারা কিনে লাগানো ভালো। তবে একটা বেডে বাঁধাকপির চারা তৈরি করে অল্পদিনের মধ্যেই তা বিক্রি করে যেমন অধিক লাভবান হওয়া যায় তেমনি নিজের প্রয়োজনও মেটানো যায়। জাতভেদে শতকপ্রতি ১.৫-২ গ্রাম বীজের প্রয়োজন।
সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা
শতকপ্রতি কম্পোস্ট সার ১২৫ কেজি, ইউরিয়া ১ কেজি, টিএসপি ০.৮ কেজি, পটাশ ০.৬ কেজি। সম্পূর্ণ গোবর ও টি এসপি সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার ২ কিস্তিতে চারা রোপণের ২০ থেকে ২৫ দিন পর একবার এবং ৩০-৪০ দিন পর আর একবার উপরিপ্রয়োগ করতে হবে। সার দেওয়ার পরপর হালকা সেচ দিতে হবে। বাঁধাকপি গাছের সারির মাঝে সার দেয়ার পর সারির মাঝখানের মাটি তুলে দুইপাশ থেকে গাছের গোড়ায় টেনে দিন। এতে সেচ ও নিকাশের সুবিধা হয়। খেয়াল রাখতে হবে জমিতে যেন পানি বেশি সময় ধরে জমে না থাকে।
আন্তঃপরিচর্যা : নিয়মিত জমি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সেচ ও সার দেবার পর জো আসা মাত্র নিড়িয়ে আগাছা বাছাই করা প্রয়োজন। চারা গজানোর ২০-২৫ দিন পর আগাছা দমন করতে হবে। গাছ খুব ঘন থাকলে পাতলা করে দিতে হবে। চারা অবস্থা থেকে রসুন গঠনের পূর্ব পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বার নিড়ানি দিয়ে জমির আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হবে। অতি বৃষ্টির কারণে জমিতে পানি বেশি জমে গেলে নালা তৈরি করে তাড়াতাড়ি পানি সরানোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
পোকামাকড় : কপির লেদাপোকা-সাইপারমেথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (যেমন ওস্তদ ২০ মিলিলিটার অথবা ম্যাজিক অথবা কট ১০ মিলিলিটার) প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০-১২ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কপির কাটুইপোকা আক্রমণ বেশি হলে কারটাপ জাতীয় কীটনাশক (কেয়ার ৫০ এসপি অথবা সানটাপ ৫০ এসপি ২০ মিলি/৪ মুখ) অথবা ল্যামডা-সাইহ্যালোথ্রিন জাতীয় কীটনাশক (ক্যারাটে ২.৫ ইসি অথবা ফাইটার প্লাস ২.৫ ইসি ১৫ মিলি/ ৩ মূখ) ১০ লিটার প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ঔষধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জাবপোকা দমনে সাদা রং এর আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করা প্রয়োজন। আক্রমণ বেশি হলে ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন এডমায়ার অথবা টিডো ৭-১০ মিলিলিটার/২মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে ১০ দিন পরপর ২/৩ বার। ওষুধ স্প্রে করায় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
রোগবালাই : মোজাইক ভাইরাস রোগ জমিতে সাদা মাছি দেখা গেলে (বাহক পোকা) ইমিডাক্লোরোপ্রিড জাতীয় কীটনাশক (যেমন- এডমায়ার অথবা টিডো ১০ মিলি. ২ মুখ) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে প্রতি ৫ শতকে স্প্রে করতে হবে। বাঁধাকপির অল্টারনারিয়া জনিত পাতার দাগ রোগ- ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক (যেমন: রিডোমিল গোল্ড ২০ গ্রাম) ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ১০-১২ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে। স্প্রে করার পর ১৫ দিনের মধ্যে সবজি বিষাক্ত থাকবে। গোড়া পচা রোগ/ ডেমপিং অফ- কার্বেন্ডাজিম জাতীয় ছত্রাকনাশক যেমন : এমকোজিম ৫০; অথবা গোল্ডাজিম ৫০০ ইসি ১০ মিলি/ ২ মুখ ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৭ দিন পরপর ৩ বার গাছের গোড়ায় ও মাটিতে স্প্রে করুন। আক্রমণ বেশি হলে প্রথম থেকে প্রতি লিটার পানিতে ২ গ্রাম রোভরাল মিশিয়ে স্প্রে করুন।
সতর্কতা : বালাইনাশক/কীটনাশক ব্যবহারের আগে বোতল বা প্যাকেটের গায়ের লেবেল ভালো করে পড়া প্রয়োজন এবং নির্দেশাবলি মেনে চলতে হবে। ব্যবহারের সময় নিরাপত্তা পোশাক পরিধান করতে হবে। ব্যবহারের সময় ধূমপান এবং পানাহার করা যাবে না। বালাইনাশক ছিটানো জমির পানি যাতে মুক্ত জলাশয়ে না মেশে তা লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। বালাইনাশক প্রয়োগ করা জমির ফসল কমপক্ষে সাত থেকে ১৫ দিন পর বাজারজাত করতে হবে।
ফল জাতভেদে শতকপ্রতি ফলন ১৫০-১৮০ কেজি হয়ে থাকে। ছায়ায় সংরক্ষণ করা ভালো। মাঝে মাঝে পানি ছিটিয়ে দিতে হবে। বেশি দিন সংরক্ষণ এর জন্য হিমাগারে রাখতে হবে। এই বছর টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত ব্রোকলি ও বাঁধাকপির চারা প্রদর্শনী মাঠ ভালো ফলাফল পাওয়ায় আগামী বছর থেকে কৃষকদের ব্রোকলি ও বাঁধাকপির চারা দেওয়া হবে। য়
লেখক : সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, এপেক্স বায়োটেক, বায়োটেকনোলজি বিভাগ (টিস্যু কালচার), গোবিন্দগঞ্জ, গাইবান্ধা। মোবাইল: ০১৭৪২-০৪৬৭৭০।